খ্রিস্টানদের কি দীপাবলি/ দিওয়ালি পালন করা উচিত?
লেখকঃ- S.Murmu
প্রথম পর্বঃ-১
আজকের বিষয় বস্তু বিশেষ করে তাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, যারা অন্য ধর্ম (হিন্দু ধর্ম) থেকে এসে খ্রিষ্টীকে বিশ্বাস করে গ্রহণ করে নিয়েছে, এবং পরে যখন দিপাবলি বা দিওয়ালি যাই বলতে পারেন আসে, তখন তারা নানা প্রশ্নের মধ্যে সম্মুখীন হয়ে যায় যে, আমি এখন কি করব কিনা করব! খ্রিস্টানদের কি দীপাবলি পালন করা উচিত। খ্রীষ্টীয় প্রিয় ভ্রাতা ও ভগিনীগনদের উদ্দেশ্যে এই বিষয় বস্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আর্টিকেলটি অনেক বড় হয়ে উঠছে তাই এই বিষয়কে দুই অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। সুতরাং আপনারা দুটি অংশ অবশ্যই অনুসরণ করবেন। আলোচনা করার পূর্বে কিছু তথ্য জানা যাক তবে বিষয় বস্তু বুঝতে সহজ হয়ে দাঁড়াবে।
Photo by RDNE Stock project |
দীপাবলি কি?
খ্রিস্টানদের কি দীপাবলি পালন করা উচিত: ভারতে দিপাবলি/ দিওয়ালি কি! এই সম্পর্কে কারোও অজানা নেই। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়ো-বুড়ি সকলেই জানেন, তা বলে এটি নয় যে, বাংলাদেশে এই উৎসব সম্পর্কে কেউ জানে না তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশেও এই উৎসব অনেক প্রচলিত, যেহেতু ভারত হিন্দু জনগষ্ঠী রাষ্ট্র তাই উৎসব নিয়ে সকলেই অবগত রয়েছেন। আমাদের প্রিয় দেশ ভারতবর্ষে, ভারত মানেই বলা হয় উৎসব প্রিয় দেশ। দীপাবলি/দেওয়ালি হল একটি পাঁচ দিন-ব্যাপী হিন্দু ধর্মীয় উত্সব যেমন; ধনতেরাস, নরক চতুর্থী, আমাবস্যা, কার্তিক শুদ্ধ পদ্যমী, এবং ভাই দুঁজ বা ভাইফোঁটা। তাছাড়া জৈন, শিখ-বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরাও এই সময়ে একই ধরনের উত্সব পালন করে থাকেন
দীপাবলির কথার অর্থ কি
দিপাবলি কথাটি “দীপ” এবং “ওয়ালি” এই দুটি শব্দের সন্ধি। “দীপ” কথার অর্থ হল; “প্রদীপ” এবং “ওয়ালি” কথার অর্থ হল; “সারি” অর্থাৎ দীপাবলি কথার অর্থ হল; “প্রদীপের সারি/সমষ্টি”।
দীপাবলি কখনও পালন করা হয়
এই উৎসব আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরাস অথবা ধনত্রয়োদশী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপাবলি উত্সবের সূচনা হয়। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই উত্সব শেষ হয়। নবরাত্রি উত্সব অথবা বাঙালিদের দুর্গোত্সব শেষ হওয়ার ২০ দিন পর দীপাবলি শুরু হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে, মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বরের মধ্যে দীপাবলি অনুষ্ঠিত হয়।
দীপাবলি কোন কোন দেশে পালন করা হয়
দীপাবলি ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, মরিশাস, গুয়ানা, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, সুরিনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিজি এমনকি বাংলাদেশে ও একটি সরকারি ছুটির দিন।
হিন্দুদের কাছে, দীপাবলি একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্সব। এই দিন সব হিন্দুরা বাড়িতে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বাংলা, আসাম, ওড়িশা ও মিথিলাতে এই দিনটি কালীপূজা হিসেবে উদযাপন করা হয়। ভারতীয় সমাজের দৃঢ় বিশ্বাস 'দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন' বা 'ন্যায়ের কাছে অন্যায়ের পরাজয়' এই পেক্ষাপটে দীপাবলি পালন করা হয়। দীপাবলির মাধ্যমে উপনিষদের আজ্ঞায় এই কথাটা খুবই সদৃঢ় ভাবে চরিতার্থ হয়ে ওঠে যথা;
বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ১/৩/২৮ “অসতো মা সত্ গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়। ওঁ শান্তিঃ॥ ওঁ শান্তিঃ॥ ওঁ শান্তিঃ॥”
অর্থাত্ “অসত্ হইতে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে জ্যোতিতে লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে অমরত্বে লইয়া যাও। সর্বত্র যেন ছড়াইয়া পড়ুক শান্তির বার্তা॥”
দীপাবলি/ দিওয়ালি পৌরাণিক কাহিনী
দীপাবলি বা দিওয়ালি পালন করার পিছনে বহু পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে যেমন ধরুন;
- শ্রীরাম অযোধ্যায় ফিরে আসার স্বাগত
- দেবী লক্ষ্মী পালনকর্তা বিষ্ণুর বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ/ শ্রী লক্ষ্মীর জন্মদিন
- শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুর বধ
- জৈন ধর্মের প্রচারক প্রবর্তক মহাবীর নির্বাণ লাভ করা
- শিখ ধর্মের যষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ ৫২ জন হিন্দু রাজপুতদের মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের হাত থেকে মুক্তি
- বুদ্ধদেব নির্বাণ লাভ করা
শ্রীরাম অযোধ্যায় ফিরে আসার স্বাগত
রামায়ণ অনুসারে বলা হয় শ্রীরামচন্দ্র পিতার আদেশ রক্ষা করার জন্য সীতার সঙ্গে চৌদ্দ বছর বনবাসে গিয়েছিল। এবং তাঁর সঙ্গে গিয়েছিল ভ্রাতা লক্ষন। ঘটনা পরম্পরায় রাক্ষসরাজ লঙ্কেশ্বর রাবণ সীতাকে হরণ করে সোনার লঙ্কায় নিয়ে যায়। তখন শ্রীরাম সীতাকে ফিরে পাওয়ার জন্য রাবণের সঙ্গে লড়াই করেন, তারপর তাঁর প্রাণের প্রিয়া সীতাকে ফিরে পান। ক্রেতা যুগের সেদিন পুনরায় শ্রীরাম অযোধ্যা ফিরে আসেন আর এই উপলক্ষে অযোধ্যা বাসি তাদের প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে সেই বিশেষ রাত্রে রাজ্যজুড়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে অভ্যর্থনা জানান/ পালন করা হয়েছিল।
এছাড়া বলা হয় এই বিশেষ দিনে তারা সেই নানা শব্দবাজি ফটকা ফাটানো এবং রং মশাল জ্বালান। তখন থেকেই দিপাবলি/ দিওয়ালি পালন করা হয়। তাই এই অশুভ দিনকে প্রত্যেক বছর মহা ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হতে থাকে যা পরবর্তীতে সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
দেবী লক্ষ্মী এবং বিষ্ণুর বৈবাহিক আবদ্ধ/ লক্ষ্মীর জন্মদিন
এছাড়াও পুরান মতে অনেকেই মনে করেন আজকের দিনে দেবী লক্ষী পালনকর্তা বিষ্ণুর সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিল। তাই অনেক হিন্দুর বাড়িতে দীপাবলীর দিনে বাড়িতে লক্ষ্মী নারায়ণের পূজা হয়ে থাকে। অন্য মতে এই দিন মা লক্ষ্মী জন্মগ্রহণ করেন আর তাই বাড়িতে মা লক্ষ্মীর আগমনে জন্মদিন মা লক্ষ্মী পূজা করা হয়।
শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুর বধ
এছাড়াও বলা হয় দ্বাপর যুগে এক রাক্ষস ছিলেন। নরকাসুর সকল রাজ্য জয় করার পর স্বর্গ আক্রমণ করেন, এবং আদিতি দেবীর কুণ্ডলজোড়া চুরি করে এবং ১৬০০০ স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যান। তখন সকল দেবতারা শ্রীকৃষ্ণ কাকুতি-মিনতি করে। পরে শ্রীকৃষ্ণ সুদর্শন চক্র দিয়ে নরকাসুর বধ করেন এবং আদিতির সোনার কুণ্ডলজোড়ার সঙ্গে ১৬০০০ জন স্ত্রীকে উদ্ধার করেন।
শ্রীকৃষ্ণ অনুরোধ করেন যে, নরকাসুর এর মৃত্যুর পূর্বে সকলে যেন তার মৃত্যুর রঙিন আলোকোজ্জ্বল ভাবে উদযাপন করে। সেইজন্য এই দিনটিকে নরক চতুর্দশী হিসাবে পালন করা হয়। পরে শ্রীকৃষ্ণ ওই ১৬০০০ স্ত্রীকে পত্নীরূপে গ্ৰহণ ও করে ছিলেন। এই দিনটিতে পূর্বভারত বাদে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে লক্ষ্মী-গণেশের পুজোর নিয়ম আছে। তাছাড়া হিন্দু ধর্মের বিশ্বাসাবলম্বী ছাড়া অন্য ধর্মের ও কিছু মহত্ত্ব রয়েছে।
জৈন মহাবীর নির্বাণ লাভ
এই বিশেষ দিন জৈন ধর্মাবলম্বীদের মতে, ৫২৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে জৈন ধর্মের প্রচারক প্রবর্তক মহাবীর নির্বাণ বা মোক্ষ লাভ করেছিলেন। তাই এই দিনটি জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বালিয়ে আলো সজ্জা করেন।
শিখ ধর্মাবলম্বী দীপাবলি/ দিওয়ালি মহত্ত্ব
এই বিশেষ দিনে শিখ ধর্মের যষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ যিনি স্বেচ্ছায় ১ বছরের মত সময় ধরে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কারাগারে বন্দি ছিলেন। তিনি যখন মুক্তি পান, পরে তিনি নিজের মুক্তির পরেও কারাগারে ত্যাগ করে যেতে অস্বীকার করেন। এবং শর্ত রাখেন তার সঙ্গে আরো যে ৫২ জন হিন্দু রাজাদেরকে মোগল সম্রাট বন্দি করে রেখেছে তাদের মুক্তি দিতে হবে। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর তার এই সব শর্ত মেনে নেন, এবং তার সাথে ৫২ জন হিন্দু রাজাদের মুক্তি দেন এ বিশেষ দিন। ১৬১৯ খ্রিস্টাব্দে শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ ৫২ জন হিন্দু রাজপুত্র দীপাবলির দিন মুক্তি পাইয়ে দিয়েছিলেন বলে শিখরাও এই উত্সব পালন করেন।
বৌদ্ধ বুদ্ধদেব নির্বাণ লাভ
এই বিশেষ দিনে বুদ্ধদেব নির্বাণ লাভের জন্য তার গৃহ ত্যাগ করেছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন। তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এই দিন প্রদীপ জ্বালিয়ে বা মোমবাতি জ্বালিয়ে বুদ্ধদেবকে স্মরণ করে থাকে।
দীপাবলি হিন্দুদের মহত্ত্ব
“দীপাবলি” নামটির অর্থ “প্রদ্বীপসমষ্টি”। এই দিন হিন্দুরা ঘরে ঘরে ছোটো মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকে। এই প্রদীপ জ্বালানো অমঙ্গল বিতাড়নের প্রতীক বলা হয়। উত্তর ভারতীয় হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে, এই দিনে বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সারা রাত প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলে ঘরে লক্ষ্মী আসেন। বাংলার দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়। এই উত্সব সাড়ম্বরে আলোকসজ্জা সহকারে পালিত হয়। বর্তমান দিনে বাড়িঘর কৃত্রিম উপায়ে আলোকসজ্জা করা হয় অমঙ্গল বিতাড়নের জন্য এবং আতসবাজিও পোড়ানো হয়। বিশেষত উত্তর ভারতে দীপাবলির সময় নতুন পোশাক পড়া, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণের প্রথাও আছে।
তবে এই পূজা প্রাচীন নয়। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে কাশীনাথ রচিত শ্যামাসপর্যাবিধিগ্রন্থে এই পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আছে, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে তাঁর সকল প্রজাকে শাস্তির ভীতিপ্রদর্শন করে কালীপূজা করতে বাধ্য করেন। সেই থেকে নদিয়ায় কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
দ্বিতীয় ভাগ অবশ্যই অনুসরণ করবেন। দ্বিতীয় ভাগ দেখতে এই লিঙ্ক অনুসরণ করুন; খ্রিস্টানদের কি দীপাবলি পালন করা উচিত
0 Comments