খ্রিস্টানদের মাতৃ/ মা দিবস পালন করা উচিত কি?
লেখকঃ- S.Murmu
এই বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পূর্বে আমরা একটু মা দিবস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব মা দিবস কি? মা দিবস কবে কিভাবে সূচনা হয়?
“মা” দিবস কি?
মা দিবস হল একটি সম্মান প্রদর্শন জনক অনুষ্ঠান যা মায়ের সন্মানে এবং মাতৃত্ব, মাতৃক ঋণপত্র, এবং সমাজে মায়েদের প্রভাবের জন্য উদযাপন করা হয়। সাধারণ ভাষায় মায়ের ভালোবাসাকে অনুভূতি করে প্রকাশ করাকেই মা/ মাতৃ দিবস বলা হয়। মা দিবস বিশ্বের অনেক অঞ্চলে বিভিন্ন দিনে উদযাপন করা হয়ে থাকে। সাধারণত মার্চ ও এপ্রিল বা মে এই মা দিবস উদযাপন করা হয়। এটি বাবা দিবসের অনুপূরক।
“মা/ মাতৃ” দিবস ইতিহাস ও সূচনা।
গ্রীক পৌরাণিক দেবদেবীদের মা, রিয়ার উদযাপনের সাথে মা দিবসটি শুরু হয়েছিল, তারপরে সপ্তদশ শতাব্দীতে যীশুর মা মেরিকে সম্মান জানাতে এই দিন স্থানান্তরিত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, ১৯৫৯ সংস্করণে উল্লেখ করা হয়েছে, “মাদার্স ডে, প্রাচীন গ্রিসে মাতৃ পূজার রীতি থেকে উদ্ভূত একটি উৎসব। যেখানে গ্রিক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী সিবেল-এর উদ্দেশ্যে পালন করা হত একটি উৎসব। এশিয়া মাইনরে মহাবিষুব -এর সময়ে এবং তারপর রোমে আইডিস অফ মার্চ (১৫ই মার্চ) থেকে ১৮ই মার্চের মধ্যে এই উৎসবটি পালিত হত। প্রাচীন রোমানদের ম্যাত্রোনালিয়া নামে দেবী জুনোর প্রতি উৎসর্গিত আরো একটি ছুটির দিন ছিল, যদিও সেদিন মায়েদের উপহার দেওয়া হত। মাদারিং সানডের মতো ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে দীর্ঘকাল ধরে বহু আচারানুষ্ঠান ছিল যেখানে মায়েদের এবং মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট রবিবারকে আলাদা করে রাখা হত। মাদারিং সানডের অনুষ্ঠান খ্রিস্টানদের অ্যাংগ্লিকানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পঞ্জিকার অঙ্গ। ক্যাথলিক পঞ্জিকা অনুযায়ী এটিকে বলা হয় লেতারে সানডে যা লেন্টের সময়ে চতুর্থ রবিবারে পালন করা হয় ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার ও “প্রধান গির্জার” সম্মানে। প্রথানুযায়ী দিনটিকে সূচিত করা হত প্রতিকী উপহার দেওয়া এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ।
১৯১২ সালে আনা জার্ভিস স্থাপন করেন মাদার’স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েশন্ (আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি) এবং “মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার” আর “মা দিবস” এইসব শব্দবন্ধের বহুল প্রচার করেন। “She was specific about the location of the apostrophe; it was to be a singular possessive, for each family to honour their mother, not a plural possessive commemorating all mothers in the world.” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস দ্বারা দিনটিকে সরকারী ছুটির দিন হিসাবে অনুমোদন করার জন্য বিল পাশের সময় আইনে এই প্রচারণারই সাহায্য নেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন এবং অনান্য মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা। এবং রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন একটি ঘোষণা জারি করেছিলেন, মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মাদার্স ডে হিসাবে মনোনীত করেন।
আপনারা মা দিবসের সম্পর্কে জানলে। এখন বাইবেল হিসেবে মা দিবস সম্পর্কে জানা যাক। আলোচনা করার পূর্বেই সকলকে জানিয়ে রাখি বাইবেল Mother's Day বা মা/ মাতৃ দিবস বলে কোন কিছু উল্লেখ নেই। এখন আবার প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায় তবে পালন করা উচিত কি না? অবশ্যই এই বিষয় আগে বিস্তারিত বোঝাব। আজকে মা দিবস দেখবেন সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে অনেকে সেলফি নিয়ে পোস্ট করে ক্যাপশন লিখে থাকে, কি লিখে থাকে তা একটু লক্ষ্য করা যাক তা এই ভাবে My Sweet Mom, My Cute Mom, My Lovely Mom, My Heart❤Mom, মায়ের ভালবাসা নাইকো তুলনা, মায়ের ভালোবাসা অসিম, আরো কি সব যে লেখা হয় তা বলা বাহুল্য ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখুন ভালোবাসা প্রকাশ করা কোন ভুল তো নয়, অবশ্যই আপনি ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু সমস্যা তখন হয়, যখন ভালোবাসাকে লোক দেখানো হয়ে থাকে।
বর্তমান দিনে খ্রিস্টান হোক বা নন খ্রিস্টান হোক দেখা গেছে যখন কেউ বিয়ে করে, বিয়ে করার পর বউমা আর শাশুড়ি নিয়তো ঝগড়া লেগেই থাকে। আর তখন স্বামী বউয়ের সপক্ষ নিয়ে নিজের মাকে শাসিত করে থাকে। কখনও কখনও শাসিত এতোটাই বেড়ে যায় শেষে মায়ের ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রমে ও হয়ে থাকে। অনেকে আবার যখন প্রেমের মায়ার জালে ফেসে যায়, তখন সেই আপজনকে ছাড়া যেন কিছুই দেখতে পায় না। তখন মায়ের প্রতি ভালোবাসা হাওয়া হয়ে যায়, মা যদি কিছু বলে মায়ের উপরে হাত উঠাতে একটুও সময় লাগবে না, কিন্তু নিজের আপন জনের কাছে ছলে-বলে কৌশলে নিজেকে ভালো সন্তান-ই দেখায় যে, আমি মাকে খুবই ভালোবাসি। অনেকের তো আবার নিয়তো পরিবারে অশান্তি লেগেই থাকে। নিজের মায়ের সঙ্গে একদই জমে না, এই সব কথা তখন হাওয়া হয়ে যায় কি কথা মনে আছে তো! চলো মনে করিয়ে দেই My Sweet Mom, My Cute Mom, My Lovely Mom, My Heart❤Mom, Love you Mom, ইত্যাদি ইত্যাদি। ঈশ্বর এই লোক দেখানো মায়ের প্রতি ভালোবাসাকে কখনও সমর্থন করেন না তাই তো যীশু বলেছিলেন। যীশু কি বলেছিলেন একটু বাক্য দেখে নেওয়া যাক।
[লূক ১৬:১৫ BCV] তিনি তাদের বললেন, “তোমরাই সেই লোক, যারা মানুষের চোখে নিজেদের ন্যায়পরায়ণ বলে প্রতিপন্ন করতে চাও, কিন্তু ঈশ্বর তোমাদের হৃদয় জানেন। মানুষের কাছে যার মূল্য অপরিসীম, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে তা ঘৃণ্য।
আমার আলোচনা অনুরূপ এই বাক্যের সহায়তা ঈশ্বর বলেছেন যে, দেখো লোক দেখানো তোমাদের মায়ের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে হবে না যে, আমি মা কে কত ভালোবাসি বলে! কোন বিশেষ একদিন আসল আর মায়ের সঙ্গে সেলফি তুলে ভালোবাসা প্রকাশ করছি। এই ধরনের ভালোবাসা আমার চোখে ঘৃনা। বরং ঈশ্বর বলছেন মা'কে কেমন ভালোবাসতে হয় তা তো আমিই তোমাদের শিক্ষা দিব। মাকে কেমন ভালোবাসতে হয় তা ঈশ্বর বলছে যথা;
[যাত্রাপুস্তক ২০:১২] তোমার পিতাকে ও তোমার মাতাকে সমাদর করিও, যেন তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তোমাকে যে দেশ দিবেন, সেই দেশে তোমার দীর্ঘ পরমায়ু হয়।
[ইফিষীয় ৬:১-২ BCV] সন্তানেরা, তোমরা প্রভুতে পিতামাতার বাধ্য হও, কারণ তাই হবে ন্যায়সঙ্গত। “পিতা ও মাতাকে সম্মান কোরো,” এই হল প্রথম আদেশ, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি প্রতিশ্রুতি , “যেন তোমার মঙ্গল হয় এবং পৃথিবীতে তুমি দীর্ঘ জীবন উপভোগ করো।”
[হিতোপদেশ ২৩:২২ SBCL] তোমার মা বুড়ী হয়ে গেলে তাকে তুচ্ছ কোরো না।
ঈশ্বরের এই ভালোবাসার প্রতীক নিজের পুএর যীশু মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। মনে রাখবেন যীশু-ই যে ঈশ্বরের সন্তান তা কিন্তু নয়। যীশু কে ছিলেন? এই সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে উওর জানতে এখানে ক্লিক করুন যীশু কে? যীশু যে ছিলেন সেই ঈশ্বর ছিলেন, কিন্তু নিজেকে জগতে পুএ যীশুর মাধ্যমে প্রকাশ করে ছিলেন তাই যীশুকে ঈশ্বরের পুএ বলা হয়। তো ঈশ্বর যখন এই জগতে এসছিলেন তখন একটি মানবীয় শরীর ধারন করে ছিলেন। যীশুর সেই পার্থিব শরীরের মা ছিলেন মরিয়ম অর্থাৎ যীশুর জাগতিক মা ছিলেন মরিয়ম। আজ থেকে দুই হাজার বছর পূর্বে যখন যীশুকে ক্রুশে দেওয়া হচ্ছিল, তখন মৃত্যুর পর্যন্ত যীশু তাঁর জাগতিক মা মরিয়মের প্রতি সন্তান হয়ে কর্তব্য/ দায়িত্ব আজীবন পালন করে গেছেন যেমন এই বাক্যেয় বলে যথা;
[যোহন ১৯:২৬-২৭] যীশু মাতাকে দেখিয়া, এবং যাঁহাকে প্রেম করিতেন, সেই শিষ্য নিকটে দাঁড়াইয়া আছেন দেখিয়া, মাতাকে কহিলেন, হে নারি, ঐ দেখ, তোমার পুত্র। পরে তিনি সেই শিষ্যকে কহিলেন, ঐ দেখ, তোমার মাতা। তাহাতে সেই দণ্ড অবধি ঐ শিষ্য তাঁহাকে আপন গৃহে লইয়া গেলেন।
অবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে যীশুর কথা বলার ভাষাশালী হিসেবে অনেকের শব্দ চয়ন করতে একটু বিভ্রান্তি হয়। অনেকে প্রশ্ন তুলে যীশু কি নিজের মাকে সন্মান করতেন? যদি করতেন তবে মাকে কেউ নারী বলা হয় নাকি? মা তো মা-ই হয় তাই নয় কি? হাঁ মা, মা-ই হয়। (গ্ৰীক গুনে আক্ষরিক অর্থে নারী, এই শব্দটা মা এবং অন্যান্য নারীর ক্ষেত্রে সম্ভ্রমসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়।) সুতরাং এখানে যীশু যেই ভাবে মরিয়মকে অভিবাদন করেছেন তা হল মা। এই বাক্য যদি সহজ সরল ভাষায় বোঝাই তা হল এই; যীশু মরিয়ম কে বলছেন মা ঐ দেখো তোমার ছেলে। যীশু যেই শিষ্যকে ভালোবাসতেন তাঁকে অর্থাৎ যোহনকে বলছেন, যোহন আমি আমার মা কে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি, তুমি আমার মায়ের দেখা শুনা করো যেন আমার মায়ের কোনো কিছু না হয়, আর যোহন যীশুর এই কথা শুনে মরিয়ম কে নিজের মায়ের মতো গ্ৰহণ করে নেয়। আর যোহন আজীবন যীশুর মাকে নিজের কাছেই রেখে ছিলেন। আমরা দেখতে পাই পরে ঈশ্বর বা যীশু যোহনকে এতো আশীর্বাদ করেছিলেন যে যীশুর ১২ জন শিষ্যদের মধ্যে যোহন-ই একমাত্র শিষ্য ছিলেন যে স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
সন্তান ক্রুশে মারা যাচ্ছেন আর সন্তান সেখানে থেকেই মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করছেন। যীশু এই দায়িত্ব মাধ্যমে মায়ের প্রতি ভালোবাসা আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন যে, আমাদের মা'কে কেমন ভালোবাসতে হয় বলে! ভালোবাসা এটাই বলা হয় নাকি কোনো বিশেষ একদিন আসল আর আমরা ফর্মালিটি পালন করে দিলাম বেশ হয়ে গেলে তা কিন্তু নয়। মায়ের প্রতি ভালোবাসা আ-জীবন থাকা উচিত। মা আমাদের এক প্রাণের স্পন্দন। মা আমাদের নানা কষ্টের মাঝে নিজের পেটে ধারন করে তিল তিল করে বড় করেন, হয়তো গঠন ঈশ্বর করেন কিন্তু ধারন তো মা করেন। মায়ের ভালোবাসা কোন বিশেষ একদিন তুলনা করা যায় না। তো এখন বলতে পারেন মা দিবস পালন করা উচিত কি না! উওর হল মায়ের প্রতি ভালোবাসার মহত্ত্ব নাকি বিশেষ একদিনের পালন করেই হয়ে গেলো। আপনি পালন করুন বা না করুন তা আপনার ইচ্ছা। বাইবেল আমাদের মায়েদের সম্মানের জন্য একটি বিশেষ দিন উত্সর্গ করার আদেশ দেয় না, বা বাইবেলে এর নিন্দার ও করে না। একটা কথা মনে রাখবেন বাইবেল প্রকৃত অর্থে মায়ের প্রতি ভালোবাসতে শিক্ষা প্রদান করে নাকি লোক দেখানো। বাইবেল বারবার আপনজনদের খেয়াল, খুশি রাখা কথা বলেন যেমন বাক্য বলে যথা;
[১ তীমথিয় ৫:৮] কিন্তু কেহ যদি আপনার সম্পর্কীয় লোকদের বিশেষতঃ নিজ পরিজনগণের জন্য চিন্তা না করে, তাহা হইলে সে বিশ্বাস অস্বীকার করিয়াছে, এবং অবিশ্বাসী অপেক্ষা অধম হইয়াছে।
ঈশ্বর সকলকে বোঝার মতো জ্ঞান প্রদান করুন।
আমেন।।
0 Comments